ইতিহাসের ‘শুদ্ধি’ অভিযানে নতুন নাম অহল্যাবাই, ত্রিশতবর্ষজুড়ে জাতীয় উদ্‌যাপন, পাঠ্যক্রমে শীঘ্রই অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা—সঙ্ঘের তরফে স্পষ্ট ইঙ্গিত

ইতিহাসের ‘শুদ্ধি’ অভিযানে নতুন নাম অহল্যাবাই, ত্রিশতবর্ষজুড়ে জাতীয় উদ্‌যাপন, পাঠ্যক্রমে শীঘ্রই অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা—সঙ্ঘের তরফে স্পষ্ট ইঙ্গিত

Spread the love

নিউজ বাংলা অনলাইন ডেস্ক, ভারত : মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে যাঁরা একদিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, সেইসব শাসকদের একবিংশ শতাব্দীতে ফের ‘প্রাসঙ্গিক’ করে তুলতে কোমর বেঁধে নেমেছে বিজেপি ও আরএসএস। সেই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন, ইন্দোরের রাজমাতা অহল্যাবাই হোলকর। ৩১ মে তাঁর জন্মের ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশজুড়ে আয়োজন হচ্ছে নানা কর্মসূচির। বিজেপি এই ত্রিশতবর্ষ উদ্‌যাপন করছে জাতীয় স্তরে, সঙ্ঘ পরিবারও সক্রিয়ভাবে যুক্ত।

তবে বিষয়টা শুধু স্মরণ বা সম্মান জানানোয় আটকে নেই। ছত্রপতি শিবাজি ও মহারাণা প্রতাপের মতো অহল্যাবাইও ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে জায়গা পেতে চলেছেন বলে ইঙ্গিত মিলছে। শিবাজি ও প্রতাপ বহুদিন ধরেই ‘জাতীয়তাবাদী’ রাজনীতির কেন্দ্রে। নরেন্দ্র মোদীর আমলে সেই ‘বিরোধিতার’ তালিকা আরও দীর্ঘ হচ্ছে। সঙ্ঘপন্থী শিক্ষাবিদরা একদিকে মুঘল শাসনের গুরুত্ব পাঠ্যক্রমে কমানোর দাবি তুলছেন, অন্যদিকে মুঘল যুগে টিকে থাকা হিন্দু শাসকদের আরও বেশি করে সামনে আনার চেষ্টা করছেন।

এই প্রবণতার এক দৃষ্টান্ত অসমের লাচিত বরফুকন। ব্রহ্মপুত্রে মুঘল নৌবাহিনীকে পরাস্ত করে যিনি উত্তর-পূর্ব ভারতে মুঘল সম্প্রসারণে ইতি টেনেছিলেন। ২০২২ সালে তাঁর ৪০০তম জন্মবার্ষিকীতে দেশজুড়ে তাঁর ‘বীরগাথা’ প্রচার করা হয়।

একই ছকে পরিকল্পিত প্রচারে উঠে এসেছেন সম্ভাজি—শিবাজির জ্যেষ্ঠপুত্র। ঔরঙ্গাবাদের নাম বদলে ‘সম্ভাজিনগর’ করা, তাঁর জীবন নিয়ে সিনেমা তৈরি ইত্যাদির মাধ্যমে বিজেপি-আরএসএস সম্ভাজিকে জাতীয় পরিসরে প্রতিষ্ঠা দিতে সচেষ্ট হয়েছে। বামপন্থী ইতিহাসবিদদের বিরোধিতা সত্ত্বেও পাল্টা প্রচারে সক্রিয় থেকেছে সঙ্ঘ পরিবার।

এ বার তাদের নজর অহল্যাবাইয়ের দিকে। আহমদনগরের একটি সাধারণ পরিবারে ১৭২৫ সালের ৩১ মে জন্ম নেওয়া অহল্যাবাই, বিয়ের সুবাদে হোলকর রাজবংশের শাসিকা হয়ে ওঠেন। মুঘল সাম্রাজ্য তখন দুর্বল। স্থানীয় বিদ্রোহীদের দমন করে অহল্যাবাই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব বারাণসীর বিশ্বনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণ—যা ঔরঙ্গজেবের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আজকের কাশীর কাশী বিশ্বনাথ মন্দির মূলত তাঁরই নির্মাণ।

৩০০তম জন্মবর্ষ উপলক্ষে ২১ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত দেশজুড়ে আয়োজিত হচ্ছে কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এর রূপরেখা তৈরি করেছে। রাজ্যস্তরে কর্মীদের দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ, কীভাবে অহল্যাবাইয়ের জীবন ও অবদান তুলে ধরতে হবে তার ওপর। পশ্চিমবঙ্গে এই কর্মসূচির দায়িত্বে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী। তাঁর বক্তব্য, ‘‘জেলা জেলায় সেমিনার হবে। মহিলা কর্মীদের বোঝানো হবে, ঘরোয়া পটভূমি থেকেও নারীরা নেতৃত্ব দিতে পারেন। সে যুগেও মহিলারা শুধুই সহমরণে যেতেন না—বরং শ্বশুর তাঁর হাতে রাজত্ব তুলে দিয়েছেন, এমন নজিরও ছিল।’’

অহল্যাবাইয়ের ‘পাঠ্যক্রম’ প্রবেশ: ইতিহাসচর্চার নামে নতুন রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস?

ত্রিশতবর্ষ উদ্‌যাপন ঘিরে শুধু স্মারক অনুষ্ঠান নয়, কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরের একাধিক নেতার সরব উপস্থিতিতে জোরদার হচ্ছে অহল্যাবাই হোলকরের ভাবমূর্তি নির্মাণ। রাজ্যে বিজেপির উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারগুলোয় বক্তা হিসেবে থাকছেন দেবশ্রী চৌধুরী ছাড়াও লকেট চট্টোপাধ্যায়, অগ্নিমিত্রা পাল, মালতী রাভা রায়, সুভাষ সরকার এবং বিমলশঙ্কর নন্দের মতো নেতারা। লকেট ও অগ্নিমিত্রারা কেন্দ্রীয় কর্মশালায় গিয়ে ইতিমধ্যেই বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

এক সাক্ষাৎকারে অগ্নিমিত্রা বলেন, “তিনশো বছর আগে এক সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা এক নারী, স্বামী ও পুত্রের অকালমৃত্যুর পর কীভাবে একা হাতে রাজত্ব সামলেছেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছেন—জানলে যে কেউ বিস্মিত হবেন। ওই এলাকায় এখনও তাঁকে ‘পুণ্যশ্লোক অহল্যামাতা’ নামে ডাকা হয়।” তাঁর অভিযোগ, ‘‘স্কুলে যে ইতিহাস পড়ানো হয়েছে, তার ৭০ শতাংশই মুঘল-কেন্দ্রিক। অহল্যাবাইদের মতো নারীদের কোনও উল্লেখই নেই।’’

তবে এটি নিছক বক্তব্য নয়, বরং স্পষ্টত পাঠ্যক্রম-ভিত্তিক রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। ভারতের শিক্ষানীতির সঙ্গে যুক্ত আরএসএস ঘনিষ্ঠ সংগঠন ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডলের (BSM) সর্বভারতীয় সংগঠন সম্পাদক বিআর শঙ্করানন্দ আনন্দবাজার ডট কম-কে জানান, “শিক্ষার সমস্ত স্তরে পাঠ্যক্রমের বিকাশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘চেয়ার’ স্থাপন করে লোকমাতা অহল্যাবাইয়ের জীবন ও দর্শনের ওপর শক্তিশালী বৌদ্ধিক ভাষ্য গড়ে তোলা প্রয়োজন।”

তিনি শুধু অহল্যাবাই নন, বরং সাম্প্রতিক কালে আলোচনায় উঠে আসা লাচিত বরফুকন, সম্ভাজি রাজে, রাজা শশাঙ্ক, কিংবা ত্রিপুরার বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্যের নামও উল্লেখ করেন। তাঁর দাবি, “এসব মহাপ্রাণদের স্মরণ ও প্রতিষ্ঠাই রাষ্ট্রীয় পুনর্জাগরণের অংশ।” একইসঙ্গে সংস্থাটির তরফে জানানো হয়, তারা এই ভাবনার বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ—যে সংগঠনের পরামর্শ ২০২০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার সরাসরি পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের কথা না বললেও ঘুরিয়ে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করে দেন। তিনি বলেন, “কোনও এক দক্ষিণ ভারতীয় কংগ্রেস সাংসদও আমাকে বলেছিলেন, আমাদের দেশে যেটুকু ইতিহাস পড়ানো হয়, তা আসলে উত্তর ভারতের শাসকদের ইতিহাস। দক্ষিণের বহু বিশিষ্ট নারী শাসকের কীর্তি সেখানে অনুপস্থিত।”

সুকান্ত নিজেও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভাগ করে বলেন, “উত্তরবঙ্গের শুক্লধ্বজ বা চিলারায়ের কথা আমরা কোথাও পড়িনি। লাচিত বরফুকনের নামও বড় হয়ে জানতে হয়েছে। যদি স্কুলের ইতিহাস যথেষ্ট হতো, তা হলে এমনটা ঘটত না।”

তবে সরকার কি সত্যিই পাঠ্যক্রম বদলের পরিকল্পনায় আছে? সুকান্ত সরাসরি কিছু বলেননি, কিন্তু তাঁর মন্তব্য—“ভারতের ইতিহাসে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তাঁদের সম্পর্কে জানার সুযোগ অবশ্যই থাকা উচিত”—এই দিশারই স্পষ্ট ইঙ্গিত।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *